এই লোকটি সম্পর্কে লিখতে গেলে ঠিক কোন জায়গা থেকে যে শুরু করা যায় সেটাই বোঝা মুশকিল। তার কোন স্কিল ছেড়ে কোন স্কিলের কথা বলা যায় ? শ্যুটিংয়ের পাওয়ার, ফিনিশিংয়ের প্রিসিশন, সতীর্থের দিকে না তাকিয়েই ফার্স্ট-টাইম শর্ট অথবা লং পাস বাড়ানোর ক্ষমতা নাকি পরিস্থিতির বিচার এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়ে তার সেই বিশ্ববিখ্যাত চোরা দৌড়ের নিখুঁত টাইমিং ? চেলসির কোচ হয়ে আসার পরেই জোসে মোরিনহোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ল্যাম্পার্ডের আঠার মতো আটকে থাকার ব্যাপারটা, কারণ ট্রেনিং করে সবাই চলে যাবার পরেও অন্তত আধ ঘণ্টা ট্রেনিং করতেন দলের এই বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার, যার শয়নে, স্বপনে ও জাগরণে শুধুই ছিল ফুটবল।
তখন ফ্র্যান্কি একটা পুচকে ছেলে, ফুটবল পাগল ছেলে। সে আর তার দলবল, তাদের ম্যাজিক ফুটবল নিয়ে পৃথিবী ঘুরে ম্যাচ খেলে বেড়ায়, বাদ পড়েনি কোনো দেশ-মহাদেশ। সে মিশরের ভুতুড়ে মমি হোক বা এলিয়েন, বা নরওয়ের ভাইকিংস কিংবা চিনের ড্রাগন। ফুটবলকে দিয়ে কথা বলায় সে; ঠিক তার স্রষ্টার মতো। ধীরে ধীরে এইভাবেই অপূর্ণ স্বপ্ন কে পূর্ণতা দিতে চেয়েছেন গল্পের এক চরিত্র তৈরি করে।
আচ্ছা আপনারাই বলুন যখন কারও ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট (আই কিউ) ১৫০-র চেয়েও বেশী হয় (স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আই কিউ ছিল ১৬০), তার মানেই যে তাকে বৈজ্ঞানিক বা গবেষক হতে হবে এমন কোন কথা আছে! তার আদর্শ জায়গা তো ফুটবল মাঠও হতে পারতো। কিন্তু রমফোর্ডের দেড়শো-উর্ধ্ব আই কিউ সম্পন্ন অত্যন্ত মেধাবী এক স্কুলপড়ুয়াকেই যখন তার ক্লাসে “তোমার ড্রিম জব” নিয়ে লিখতে দেওয়া হয়, আর উত্তরে সে লেখে “ফুটবলার”; ক্লাসের শিক্ষিকা সেটা দেখেই বলে ওঠেন, “কিন্তু ফুটবলার হওয়াটা তো কোনো জব নয়! আর তাছাড়া প্রতি ৩০০ জনের মধ্যে মাত্র একজন বাচ্চাই ফুটবলার হতে পারে। তুমি কি মনে করো যে সেই একজন তুমি হবে?” — “হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি” — বলে ওঠার পর থেকেই তার সহপাঠীদের কাছে সে হয়ে যায় উপহাসের পাত্র।
পাশের বেঞ্চ থেকে হাসা ক্লাসের সেই বাকি ছেলেগুলো বড় হয়ে নিজেদের নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কতটা সফল হয়েছিল জানা যায়নি কিন্তু যাকে নিয়ে তারা বিদ্রুপ করেছিল সেই ছেলেটিই একদিন ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেড থেকে চেলসিতে সই করেছিল ১১ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফি’র বিনিময়ে — সেই অঙ্ক যার প্রলোভন সামলাতে পারেননি ওয়েস্টহ্যামের চেয়ারম্যান আর যা দেখে লিডস ইউনাইটেডের মালিক মন্তব্য করেন, “ওভারপ্রাইসড”। যদিও এরপর থেকে লিডসের মালিককেও সেই স্কুল টিচারের মতই সারাজীবন আফসোস করে কাটাতে হয়, কারণ তার দল ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে গিয়ে সেখানেই আটকে থাকলেও যাকে নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন পরবর্তীকালে সেই হয়ে যায় ফুটবলের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা গোলস্কোরিং মিডফিল্ডার — ফ্র্যাঙ্ক জেমস ল্যাম্পার্ড।
তিনি এমন একজন খেলোয়াড় যিনি তার কেরিয়ারের মধ্যগগনে চেলসির জার্সি গায়ে যে হারে গোল করে গেছেন সেই একই স্কোরিং রেট ফুটবল জীবনের শায়াহ্নে পৌঁছে নিউ ইয়র্ক সিটির হয়েও ধরে রেখেছেন,
একটা দলের হয়ে ১৩ বছর খেলে কোনো স্ট্রাইকারও যদি ১৯৩টি গোল করেন তবুও সেটাকে খুব একটা খারাপ রেকর্ড বলা যায়না। কিন্তু ওই একই পরিসরে একজন মিডফিল্ডার যখন আরো ২০টি গোল বেশি করেন সেটা বোধহয় এককথায় অবিশ্বাস্যই বলা চলে। এই বিরল কৃতিত্ব অর্জনের মাধ্যমে চেলসির ক্লাব ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পথে ল্যাম্পার্ড জিতেছেন ৩ টি প্রিমিয়ার লিগ, ৪ টি এফ এ কাপ ও একটি করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর ইউরোপা লিগের খেতাব। তিনবার তিনি হয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট প্রোভাইডার। কখনো তিনি চোট সারিয়ে ফেরার পর মাঝমাঠে তার উপস্থিতিই এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে তার সহখেলোয়াড়দেরও আত্মবিশ্বাস। বিশেষ করে ফার্নান্দো টোরেসকে সম্পূর্ণ আলাদা খেলোয়াড় মনে হয়েছে যখন তাকে পেছন থেকে বল বাড়িয়েছেন “সুপারফ্র্যাঙ্ক”, আর একজন খেলোয়াড়ের এই জাতীয় গুণ কিন্তু কখনোই অর্থের বিনিময়ে কেনা সম্ভব নয়।
অথচ মাঝমাঠে তাঁর খেলা, যেন এক একেকটা ক্যানভাসে সযত্নে আঁকা ছবি। অসামান্য পাস, নির্ভুল বল ডিস্ট্রিবিউশন ছাড়াও নীলজার্সি গায়ে ১৪৭ খানা গোলের সাক্ষী থেকেছে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ। সাক্ষী থেকেছে প্রিমিয়ার লীগ, দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছে পুরো ফুটবল বিশ্ব।