এইতো কয়েকদিন আগেই স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত “হেমলেট” নাটকটি পড়েছিলাম। সেখানে একটা পার্টে এমন একটা উক্তি পেয়েছিলাম তা ছিল -“There are more things in heaven and earth than there are dream of in your philosophy” আসলেই আমরা স্বপ্নে যা চিন্তা করি তার থেকেও সুন্দর কিছু এই পৃথিবীতে রয়েছে তবে তা দেখার জন্য আমদের দেখার মতোই চোখ থাকতে হবে।
ফুটবল বিশ্ব যুগে যুগে অনেক নান্দনিক প্লেয়ার দেখেছে তবে খুব কম প্লেয়ারকেই আমরা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছি। স্বপ্নের ক্যাম্পাসে আমরা যে ফুটবলটাকে কল্পনা করি বাস্তবে অনেক খেলোয়াড় এর চেয়ে বেশি শিল্প নিয়ে ফুটবলটকে রাঙ্গিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা তা দেখতে পারি না, কেননা আমাদের তা দেখার মতো চোখ খুব কমই থাকে। তেমনি একজন গত দেড় দশক ধরে ফুটবল মাঠের বুকের ডান পাশ জুড়ে ওভারলেপিং করে একেছে একের পর এক চিত্রকর্ম, কিন্তু আমরা তা দেখেছিই বা ক’জন?
আমাদের জেনারেশন তো ডানপাশ বলতেই কল্পনায় একে ফেলে লিও মেসিকে কিংবা বাম পাশ বলতে সহজেই কল্পনায় একে নেয় ক্রিস্টয়ানো বা নেইমারকে! কিন্তু একটা দানি বয়কে কয়জনই ডানপাশ বলে কল্পনায় রাখে? ৫০০ বছর আগে শেক্সপিয়ার যে আসলেই ভুল কিছু বলে নি তা উপলব্ধি করতে পেরেছি একজন দানি আলভেজকে দেখে।
সময়টা ২০১৪ সাল, ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ‘এস্তাদিও ডি সেরামিকা’ তে প্রায় ২৪ হাজার দশর্কদের মাটিতে এওয়ে ম্যাচ খেলতে নেমেছে বার্সেলোনা। ম্যাচের ৭৫ তম মিনিটে ডান প্রান্তে কর্নার কিক নেওয়ার জন্যে এগিয়ে যান দানি আলভেজ। কর্নার কিক নেওয়ার সময় ঠিক তখনই এক সমর্থক বর্ণবাদের চরম রুপ প্রকাশ করলেন। ঐ সমর্থক দানি বয়ের সামনে একটি কলা ছুড়ে মারেন। একজন দানি আলভেজ তাৎক্ষণিকভাবে সেদিন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যে দারুণ এক জবাব দিয়ে ছিলেন তা মুহুর্তের মধ্যই একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয় সারা বিশ্বে।
কি করেছিলেন দানি বয় সেই মূহুর্তে? দানি কলাটি মাঠ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে খেয়ে নেন পুরোটা কোন বাজে অভিব্যক্তি ছাড়াই। মাঠে বসা দর্শক কিংবা টিভি সেটের সামনে বসা কোটি দর্শকদের সামনে আলভেজ যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল তা ঠিক ক’জনই পেরেছিল বা পারবে!
এতো গেলো দানি বয়ের কাছে সামান্য এক ভালবাসার দৃষ্টান্ত, আরেকটি কাহিনী শুনলে তো আপনি এখন যে অবস্থায় লেখাটা পড়ছেন সেই অবস্থাই আপনার কপালে ভাজ পরে যেতে পারে কিংবা কয়েক মূহূর্তের জন্য শেক্সপিয়ারের গল্পের মতো কল্পনায় একে ফেলবেন আপনার কাছের বন্ধুদের কথা। তাৎক্ষণিক ভাবে মনে হবে হয়তো কাছের বন্ধুর সাথে কত স্মৃতি বিজারিত গল্প।
আচ্ছা একটা অপ্রাসঙ্গিক কোশ্চেন হয়ে যাক কেমন! আপনি আপনার বন্ধুর জন্যে সর্বোচ্চ কি করতে পারবেন? হয়তো বন্ধুর জন্যে মারামারি করতে পারবেন কিংবা সর্বোচ্চ বন্ধুকে জরুরি মূহুর্তে মোটা অংকের টাকা ধার দিতে পারবেন। আর কিছু? কিন্তু আপনি কি আপনার বন্ধুর জন্যে নিজের ‘যকৃতটুকু’ দান করতে পারবেন? অসম্ভব! পৃথিবীতে এমন মানুষ হয়ত হ্যালির ধুমকেতুর মত ৭৬ বছরে কিংবা শতাব্দীতে খুঁজে পেতে পারেন যে কিনা বন্ধুর জন্যে নিজের জীবনের এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকবে! অথচ একজন দানি আলভেজ সেদিন তার সতীর্থ বন্ধুর জন্যে নিজের যকৃতের একটি অংশ দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! তার সতীর্থ আবিদাল বলেন, “যখন আমি অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে তার যকৃত দান করতে চেয়েছিল ক্যারিয়ারের ঝুকি নিয়ে। যদিও তেমনটা করার কোনো প্রশ্নই ছিল না, কারণ সে নিজেও একজন পেশাদার ফুটবলার।”
টিভিতে আজকের খেলা কার, কখন দেখতে
এমন দু একটা ঘটনা দিয়ে দানি বয়’কে ভালোবাসার কারণ বুঝানো সম্ভব না। একজন দানি বয়কে ভালোবাসার অসংখ্য কারণ রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা এই মানুষটাকে পৃথিবীর অন্যতম গুনটা দিয়েছেন হয়তো। মানুষ’টার সবচেয়ে বড় গুণ হলো তিনি হাসতে পারেন, সবাইকে সমান তালে হাসাতে পারেন, সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারেন। একটা ড্রেসিংরুমে সতীর্থ সবাইকে হাসিমুখে রাখার কৌশল রসিকতাপ্রিয় দানি’র চেয়ে আর কেই বা বেশি জানে! তাই দানিকে সবাই স্প্যানিশ ভাষায় ডাকে “এল লোকো” নামে, যার বাংলা অর্থ পাগল বা উন্মাদ! যে মানুষটা সারাদিন যেসব হাস্যরসাত্মক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়, তাকে পাগল না ডেকে কিই বা আর ডাকা যায়? ফুটবল ঈশ্বর হয়তো তাকে খেলার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তাইতো ফুটবল ঈশ্বর ফুটবলীয় সব গুন তার মধ্য প্রতিস্থাপন করেছেন। অনিন্দ্য এই ফুটবল বিশ্বে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র বলাই যায় তাকে।
ঈশ্বরপ্রদত্ত এসিস্ট করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই দানি বয় ছিল মেসির ঘনিষ্ঠ সহযোগী যোদ্ধা। লিও কে গোল করাতেই যেন তার স্বাছন্দ্য সেখানে নিজের স্বভাবসুলভ সেলিব্রেশনে মাটিতে জড়িয়ে মেসিকে নিয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে যেতেন। কোন পজিশনে খেলতেন সেটা বড় কথা ছিল না, পুরো মাঠ চষে বেড়ানোকে এক প্রকার আর্টে পরিণত করেছিলেন। বার্সার হয়ে ৮ বছরেরে পথচলাকালীন মাঠিখুড়ে বের করে ফেলেছিলেন ইউরোপের সব ধনরত্ন। হয়েছেন ডিফেন্ডারদের মধ্য সর্বকালের সেরা এসিস্ট প্রোভাইডার, উচলের সর্বচ্চো এসিস্ট কিং।
বার্সা বোর্ড তোমার কদর কেন করেনি জানি না, তা জানতেও চাই না কখনো! তবে এটা চিরন্তন সত্য যে প্রতিটি কিউলের অন্তরে তুমি ভালবাসার প্রতিক হয়ে মিশে আছো এবং থাকবে যেমনটা পৃথিবীতে চন্দ্র- সূর্য্য বিরাজমান।
সময় পেড়িয়ে যায়…..