– মাশরাফি কে চেনেন? – মজা করছেন? মাশরাফিকে চেনবনা কেন? – দেখেন তো চেনেন কিনা? “ছোট্ট ঘরটায় ছোট্ট একটা জানালা। জানালা ছোট হলেও তাকালে চোখে পড়ে বিশাল একটা আকাশ। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু নিচের দিকে তাকাতে চোখে পড়ল বিলাসবহুল একটা বাড়ি। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম [দেবব্রত মুখোপধ্যায়]
আপনি চাইলে ও রকম একটা বাড়ির মালিক থাকতে পারতেন।’ চোখটা আকাশ থেকে না নামিয়ে হাসলেন তিনি। ঠোঁটে বাঁকা হাসিটা ঝুলিয়েই আঙুল দিয়ে দূরের রাস্তা দেখালেন। রাস্তার পাশে পলিথিনের তাঁবু খাটিয়ে একটা পরিবার থাকে বুঝি। ফুটপাতের ওপর সেই পরিবারের একটা বাচ্চা দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। হেসে বললেন,’ওই বাড়িটাই শুধু চোখে পড়ল? ফুটপাতের ওই মানুষগুলোকে দেখলেন না! আল্লাহ চাইলে ও রকম জায়গায়ও থাকতে পারতাম।’ একটু বিরক্ত লাগল। আমি কি বলতে চাইছি, তিনি কি বুঝতে পারছেন না? অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, ‘তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি,আপনার যে সামাজিক মর্যাদা,তাতে আপনার আরও ধনী থাকার কথা ছিল। আপনার জুনিয়র অনেক ক্রিকেটার আপনার দশ গুণ ধনী।’ মাশরাফি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আমার সিনিয়র অনেক মানুষ যে আমার চেয়ে দশ গুণ গরীব,সে খেয়াল আছে? শুধু ধনীদের হিসাব করেন কেন? হিসাবের নেশা খুব খারাপ।’ ” [ মাশরাফি-দেবব্রত মুখোপধ্যায়]
জ্বী এটাই মাশরাফি, এটাই তার দর্শন। কি গোলক ধাঁধায় পরে গেলন? এত সবে শুরু। ‘তুই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিস’ ‘ও আচ্ছা!’ মহাশয়ের কাছে যেন জাতীয় দলে ডাক পাওয়া সকালে জল-ভোজের মতো! তিনি যে এ বাংলার বুকে রাজত্ব করতে এসেছেন তা কি তিনি জানতেন? সে তো বড়ই রহস্য!
৮ নভেম্বর ২০০১… বাংলাদেশের ক্রিকেটে সে এক মহাগাঁথার প্রারম্ভ, ষোল কোটি হৃদয়ে রাজত্ব করা সে এক রাজার আগমনীর লগ্ন ১৭ বছরের লিকলিকে গড়নের যুবার মাথায় যখন ক্রিকেটের বনিয়াদি ফরমেটের ১৯ নম্বর ক্যাপটি মাথায় পরিয়ে দেয়া হল তখন আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মহানায়কেরা নাকি তাদের আগমনী বার্তা দিয়ে যায়! তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। পরেরদিন, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার থেকে শুরু করে ক্রিকোনাইফোতে তার গতির ঝড়! সেদিন, প্রোডিয়ামে সাংবাদিকেরা খুব আফসুস করেছিলেন স্পিডোমিটারের অভাবের। সে ম্যাচে মাশরাফি প্রথম ইনিংসে ৩১ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯ অভার বল করেন সবে মিলিয়ে ৬০ অভার। আজ সে গতি আর নেই। ইঞ্জুরির কাছে সেই গতি কবেই আত্মসমর্পণ করেছে।
গতি কমেছে ঠিকই কিন্তু তার লাইন লেন্থ আজও প্রতিপক্ষকে কাঁপন ধরাতে যথেষ্ট। অনেকের মতে এর কারন ক্যারিয়ারের শুরুতে মাশরাফিকে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফল। তা সে জেনে বুঝেই হোক, আর না জেনেই হোক, ‘কোনো কিছুর অতিরঞ্জিত’ এর ফল আজও বাংলাদেশ ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের বড্ড পীড়া দেয়। আবার অনেকে মাশরাফির ডায়েট প্লেন আর কিছুদিন পর পর নড়াইল যাওয়াকেও দায় দেন। বলতেই হয়, মাশরাফি এখন আর ছুটি পেলেই নড়াইল ছুঁটে যাননা, কিংবা তেল আর ভাজা মাংসের বদলে তার খাবার মেনুতে জায়গা করে নিয়েছে সিদ্ধ মাংস, আর সালাদ। তিনি বলেন ‘প্রথম প্রথম খেতে কষ্ট হবে, পরে অভ্যেসে পরিণত হবে।’ ভাইরে মায়ের হাতে খিচুরি আর গরুর মাংসকে দূরে ঠেলে সালাদ খাওয়ার মতো ত্যাগ এমনিতেই আসে না, এগুলো দেশের প্রতি ভালোবাসা আর ডেডিকেশনেরই ফল, একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকই বলতে পারেন।
দেশকে ভালোবেসেছিলেন বলেই তো ক্যারিয়ার শেষে হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করতে হবে জেনেও আজও ২২ গজের পিচে ঘাড়টা বাঁকা করে বল করে যাচ্ছেন।
২০০৭ সালে বিশ্বকাপে ইন্ডিয়ার ম্যাচের আগের দিন টিম হোটেলে বাশারের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলে সবাই ভেবেছিল, ইন্ডিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের জন্য শুভকামনা জানানোর জন্য দেশ থেকে ফোন হবে হয়তো। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আছে রানার মৃত্যুর খবর। যারা ক্রিকেট ফলো করেন তারা জানবেন মাশরাফি রানা শুধু বন্ধু ছিল না, ছিল দুই ভাই। ঐ সংবাদ মাশরাফিকে কতটা ছুঁয়ে গিয়েছিল ইন্ডিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের দিন সকালে মাশরাফির গাঁয়ে ১০৩° জ্বরই বলে দেয়। সেই জ্বর নিয়েই খেলেছিলেন। কারন তার যে ‘খেলতি হবি, রানার জন্য খেলতি হবি’ ‘ভারতকে ধরে দেতি হবি’।
হ্যাঁ ঐদিন নড়াইল এক্সপ্রেস ভারতকে ঠিকই ‘ধরে দিয়েছিলেন’। পাইলট-বাশারদের, মাশরাফি-রাজ্জাক-রানাদের দুরন্তপনা নাকি কাঁপন ধরাত, ‘ইঞ্জুরি টিঞ্জুরি না বাঁধিয়ে বসে।’ এখন আর সেই দুরন্তপনা আর নেই। ১১ বিশ্বকাপের সময় হুমায়রার মর্তুজার স্ট্রাগলিং বার্থ, সুমনা হক সুমিকে পর্যাপ্ত সময় না দেয়া, একজন দুরন্তপনা যুবককে একজন পিতা, একজন স্বামী আর মনে হয় একজন ম্যাচিওর ব্যক্তির আড়ালে একজন নেতায় পরিণত করেছিল।
‘বিধাতা যা করেন ভালোর জন্যই করেন’ । তাইতো ঘরের মাঠে মাশরাফিকে ছাড়া বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশ নাস্তানাবুদ হচ্ছিল তখন ঢাকা মেডিকেলে নতুন বাংলাদেশের বীজ রূপন হচ্ছিল। ২০১৪ ছিল ডিসাসটারাস একটি বছর। সে বছর বাংলাদেশ হংকংয়ের মতো দলের কাছেও হারে। তারপর মাশরাফির দায়িত্ব তুলে নেয়া, আর ঠিক পরের বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সাফল্যমন্ডিত বছর। সে বছরই বাংলাদেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে,ঘরের মাঠে পাকিস্তান-ইন্ডিয়া-সাউথ আফ্রিকা কে হারায়। যে দল হংকংয়ের বিপক্ষে হার, অধিনায়কের পরিবর্তন এবং ঠিক পরের বছর সে দলের ঘরের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা কিংবা ১৭ এ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা কি কাকতালীয় মনে হয়?
ক্যারিবিয়দের বিপক্ষে টেস্টে কোনো প্রতিরোধ গড়তে না পারা দল যখন ওয়ানডেতে তার আগমনের পরই ডমিনেট করে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয় তখন বিষয়গুলোকে কাকতালীয় মনে হয় না। আপনারা বলেন ভয়-দরহীন বাংলাদেশের কথা। আমি বলি ভয় কে জয় করানো শিখানো ব্যক্তির কথা। আপনারা বলে যান অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের গল্প আমি গেয়ে যাই সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের কারিগরের গান। আমি তার কথা বলি যে ক্যাপ্টেনের আর্মবেন্ড পরে ড্রেসিংরুমে এসে বলেছিল ‘লড়াই করলে আমাদের কেউ মনে রাখবে না আমাদের জিততে হবে।’ আমি বলি জিততে শেখানো শিক্ষকের কথা। আমি বলি একজন বড় ভাইয়ের কথা যে তাসকিন -ফিজের ইঞ্জুরি নিয়ে সর্বদা চিন্তিত থাকে। কিংবা কোনো প্রতিভাবান তরুনের জীবনের অনিয়ম দেখলে পরামর্শদাতা বনে যাওয়া এক পাগলার কথা।
আমি বলি একজন বন্ধুর কথা যে তামিমের অফ ফর্মের সময় তাকে ফর্মে ফেরার টোটকা দেয়। ফলাফল, বিশ্বকাপে স্কল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রান। আমি বলি একজন লিডারের কথা, যে নিজের ছেলের হসপিটালের বেডে থাকার কথা সতীর্থদের বলে বিশ্বকাপে ঊড়তে থাকা দলের মানসিকতা চেঞ্জ করতে চান না। -মাশরাফি ভাই দল জিততাছে, খান না কেন? -এমনি! ছেলেকে বেডে রেখে কি কোনো বাবার গলা দিয়ে খাবার নামে?
আজকের খেলা কখন, কোন চ্যানেলে দেখতে ক্লিক করুন
আমি বলি যোগ্য প্রতিপক্ষের কথা, যে সাউথ আফ্রিকাকে চোকার বলার মোক্ষম সুযোগকে পায়ে ঠেলে বলেন ‘আমি জানি না কারো এভাবে বলা ঠিক কিনা। আর আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, কোনো জাতিকে এভাবে আঘাত করা ঠিক না। আমি বিশ্বাস করি ওরা খুব বড় দল। আমার কাছে মনে হয় পুরো দেশটাই এতে কষ্ট পায়। মানুষকে একটা জাতিকে এভাবে কষ্ট দেয়ার অধিকার কারো আছে কিনা!’ আমি বলি একজন দেশপ্রেমিক মাশরাফির কথা, যে পঙ্গু হওয়ার ভয় নিয়েও খেলে যায়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষের জয়কে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে, রাস্তায় ময়লা ফেলতে বারণ করে। আমি জিজ্ঞেস করি চেনেন এ মাশরাফিকে?