ফুটবলে আর যাই হোক গোলের সুযোগ তৈরী করা আর সেই সুযোগগুলোকে গোলে পরিণত করাই হল ফুটবলের অন্যতম শেষ কথা। গেম রিডিংয়ের অভাবনীয় দক্ষতা আর মাঝমাঠ থেকে দলের আক্রমণ রচনা করার সহজাত প্রবণতাসম্পন্ন ফরাসি মিডফিল্ডার মিশেল প্লাতিনির জীবনদর্শনও ঠিক এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফ্রান্সের আক্রমণভাগকে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই প্লে-মেকারের উচ্চমানের পাসিং স্কিল ভেঙে দিতে পারতো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ডিফেন্স লাইনকেও। ফ্রি-কিক ও ফিনিশিংয়ে সিদ্ধহস্ত এই ফুটবলারের অধিনায়কত্বেই ১৯৮৪ সালে ইউরো কাপ জয় করে ফ্রান্স।
বিশ্বকাপে মিশেল প্লাতিনির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৮ সালে, যেবার তার দেশ দীর্ঘ ১২ বছর পর বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। যদিও সেই টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্যায় থেকেই তাদের বিদায় নিতে হয়, কিন্তু প্লাতিনির নান্দনিক ফুটবল সবার প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়। বিশেষ করে ইতালির খেলা দেখে এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে তারা নিজেদের স্ট্র্যাটেজি বানানোর ক্ষেত্রে আলাদা করে প্লাতিনিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল, আর সাফল্য না পেলেও এই বছরটাই ছিল ফরাসি ফুটবলের ব্রেক-থ্রু ইয়ার।
৭৮ এর বিশ্বকাপের পর এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের হাতেই তুলে দেওয়া হয় ফ্রান্স দলের ক্যাপ্টেন্স আর্ম ব্যান্ড আর সেইসঙ্গে দলের প্লে-মেকারের জন্য বরাদ্দ ১০ নম্বর জার্সি। নতুন ভূমিকায় তার প্রথম লক্ষ্যই ছিল তার দেশকে ১৯৮২ বিশ্বকাপের মূলপর্বে উত্তীর্ণ করা। হল্যান্ডর বিরুদ্ধে কোয়ালিফায়ার পর্বের নির্ণায়ক ম্যাচের নির্ণায়ক মুহূর্তে হতাশ করেননি প্লাতিনি। ফ্রি-কিক থেকে তার সেই অনবদ্য গোলই নিশ্চিত করে ফ্রান্সের বিশ্বকাপের টিকিট।
স্পেনে আয়োজিত ১৯৮২ বিশ্বকাপে আগাগোড়া দুর্দান্ত ফুটবল খেলে মিশেল প্লাতিনি ফ্রান্সকে ২৪ বছর পর পৌঁছে দেন সেমিফাইনালে। শেষ চারে পশ্চিম জার্মানীর বিরুদ্ধে নির্ধারিত নব্বই মিনিটে খেলা ১-১ ড্র থাকার পর চার চারটি গোলে ঠাসা নাটকীয় এক্সট্রা টাইম আর অমীমাংসিত টাইব্রেকারের শেষে সাডেন ডেথে ফ্রান্সের হেরে যাওয়ার সেই ম্যাচটি বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর ম্যাচ হিসাবে চিহ্নিত। যদিও তাদের দুর্ভাগ্য যে পশ্চিম জার্মানীর গোলরক্ষক হ্যারল্ড শ্যুমাখারের প্যাট্রিক ব্যাটিস্টনকে করা একটি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ফাউল রেফারির নজর এড়িয়ে যায়, যেটা না হলে হয়তো খেলার ফলাফল অন্যরকম হতেই পারতো।
এরপর ১৯৮৬ তে আবারও পশ্চিম জার্মানীর কাছে হেরে যায় ফ্রান্স আর এর মাধ্যমেই ইতি ঘটে খেলোয়াড় প্লাতিনির বিশ্বকাপ সফরের।
তারপর ? তারপর আর কী ! ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এলো চোখের চারপাশ টা ।
আর পারলো না ছেলেটা।
দম আটকে আসছে যে। পা দুটো কে যেন কামড়ে ধরেছে।
কাম অন মাইকেল, ইউ ক্যান”, বাবার কথাগুলো কানে আসতে আসতেই লুটিয়ে পড়ল মাইক।
এই নিয়ে চারবার।
জবাব দিয়ে দিলো ডাক্তার, ‘চাইল্ডহুড অ্যাজমা’, কিছুুুুতেই ফুটবল খেলা যাবে না।
প্রত্যাবর্তনটা ঠিক-ই হল, হ্যাট্রিক সহ চারগোলের সাথে।
বারবার ফিরে আসা নায়কদের গল্পটা এই একই ধাঁচের হয়।
কিন্তু নায়কের ঊর্ধ্ব-এ মহারাজা এক-আধজন ই হয়।
ফরাসি ফুটবলের রাজা তিনি – ‘লে রয়’।
মাঝমাঠ শাসন করেছেন।
সামনে থেকে দল সামলেছেন।
ফ্রিকিক এর যাদু দেখিয়েছেন।
আর বারবার ফিরে এসেছেন প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে।
৮৩, ৮৪, ৮৫ তিন বছর ব্যালন-ডি-অর তার। ৯৯ সালে শেষ শতকের সেরা ফরাসি প্লেয়ার আর ফিফা ঘোষিত সর্বকালীন সেরা ১০০ প্লেয়ারের একজন।
অবসরে তার ফুটবল প্রেম নতুন মাত্রা পায় পরিচালক হিসেবে। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ আর ১৯৯২ ইউরো কাপে তার প্রশিক্ষণেই খেলেছিল তার দেশ।থেমে থাকা তে যে তিনি অভ্যস্ত নন !
পর পর তিনবার ব্যালন ডি’ওর জয়ী এবং ফিফার শতাব্দীর সেরা ফুটবলারের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানাধিকারী প্রাক্তন উয়েফা প্রেসিডেন্ট মিশেল ‘দ্যা কিং’ প্লাতিনির। ৬৬তম জন্মদিনে গেলো ২১শে জুন তাকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।