আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের ফুলপরী
ফুলপরী লাল পরী লাল পরী নীল পরী
সবার সাথে ভাব করি।।
এইখানে মিথ্যে কথা কেউ বলেনা
এইখানে অসৎ পথে কেউ চলেনা
এই যা, ধান কাঁটতে গিয়ে শিবের গান ধরলাম বুঝি? নাহ্, ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা প্রায় ৩ এর ঘরে আর মিনিটের কাঁটা ১২ এর ঘরে আড় হয়ে যখন আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখন অযথা ছোট্টবেলার এ গান ধরতে আমারও বড্ড ভয় করবে।
একজন নবজাতক যখন নীল গ্রহে তার আগমনীর বার্তা দেয় তখন তার কাছে সবকিছু যেন স্বর্গীয় মনে হয়। সবকিছুতে সে এক চমৎকার সুধা পায়, পৃথিবী তার কাছে এক স্বপ্নপুরী। কিন্তু যখন সে বেড়ে উঠে তখন পারিপার্শ্বিকতার কালো থাবা তাকে গ্রাস করে, তার স্বপ্নপুরী রাবণের লঙ্কায় পরিণত হয়। সে সময়টায় সে এক নতুন শব্দের আবিষ্কার করে ‘ছল’। তার সুন্দর ধরণী আসলে সুন্দরই আছে তবে রাক্ষসের রাজত্বে তার সৌন্দর্য ঢাকা পরেছে। অবশ্য আপনি যদি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো কল্পনাবিলাসী হন তবে আপনার কাছে এগুলো শুধু অযৌক্তিক কথাই লাগবে। বার্সার প্রেমে পরি ২০১৪ তে তখন মনে হতো এরা সর্বজয়ী, কোনো বাঁধা এদের সর্বজয়ের যাত্রার পথ রুদ্ধ করতে পারবে না, সর্বজয়ের যাত্রায় বাঁধা দিতে যে সামনে এসে দাঁড়াবে তাকেই তছনছ করে দিয়ে ব্লাউগ্রানারা এগিয়ে যাবে তাদের লক্ষ্যে, সে এক রূপকথা। ব্লাউগ্রানারা শুধু যে সর্বজয়ের গল্প রচনা করত তা কিন্তু বড্ড ভুল; এ এক স্বপ্নপুরী যেখানে বন্ধুত্বের এক অনন্য উদাহরণ পাওয়া যেত, যেখানে তিন ত্রয়ীর খিস্তীতে অটখাল্লা হতে বাধ্য হতে হতো। সেখানে এক ঐশ্বরিক আনন্দ ছিল। তবে রামরাজ্যে রাম থাকে না তার স্থান বনবাসে। আর রাবণের মতো যুগে যুগে রাক্ষসদের আগমন ঘটে যারা তাদের কপটতার হুঙ্কারে জানান দেয়, সমাজের কালো থাবার। আমিও বেড়ে উঠেছি আমার রামরাজ্যেও আগমন ঘটেছে রাক্ষসের। যার ভয়াল থাবায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে মেরুন-নীল।
এই নির্জন রাতে স্মৃতির পাতা হাতরাতে ইচ্ছে করছে খুব। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি কিংবা স্টিফেন হকিংসের শত-শত তত্ত্ব ঘেটে টাইম মেশিন বানানোর মতো অতটা বিজ্ঞ আমি নই, আর কি করার হাতের সামনে অভ্রই ভরসা।
লায়লা-মজনুর অমর প্রেমগাঁথায় ঐশ্বরিকতা পাওয়া যায়। এমন কিছু কি আদৌ আছে? স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলে বিশ্বাস করতে শখ জাগে বৈকি। খুব ভালো করে বসুন রাইডে করে নিয়ে যাই সে সময়টায় —
১.
কি যেন একটা অন্যায় করেছিলাম! ভর্তি ক্লাসে স্যার সামনে আসতে বলল আমাকে। ছোট-ছোট কদমে হাঁটছি, এ পথ শেষ না হলেই যেন আমি বাঁচি। পুরো ক্লাস ডেব-ডেব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ইচ্ছে করছে, মাটি খুঁড়ে মাটির মধ্যে ঢুকে যাই। আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়ালাম, গাঁ পুরো হিম হয়ে গেছে আমার। স্যার কি যেন একটা জিজ্ঞেস করল! সামনের বেঞ্চ থেকে আগ বাড়িয়ে ছেলেদের মধ্য থেকে একজন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে বলে ওঠল-
– স্যার, ও তো রাত জেগে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখে!
কথা শেষ হওয়ার আগেই পুরো ক্লাসের অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ! উফ্!! কোথায় আমি? কে কোথায় আছ আমাকে বাঁচাও!!
স্যার এই কথারই পুনরাবৃত্তি করল কিছুটা অন্য ধাঁচে
– কি, সাদিয়া! তুমি নাকি ফুটবল দেখ?
স্যারে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমা যেন অট্টহাসির মাত্রা আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিল!! নির্লিপ্ত আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি!! স্যার ফিরতি বলল-
– আচ্ছা বলো তো, ফাইনালে স্পেন জিতেছে তা তো সবাই জানে, এইটা বলো ফাইনালে কে গোল করছিল?
এবার নিশ্চুপ না আসলেই ঊত্তরটা আমার জানা ছিল না। ঊত্তর না পেয়ে স্যার আবার জানতে চাইলেন-
– ফাইনালে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ কে হইছে?
২.
সেদিন আমি আসলেই জানতাম না, স্পেনের ত্রাতা কে ছিল কিংবা স্পেনের ক্রীড়া ইতিহাসের কাঙ্ক্ষিত দিনের সেরার নাম। আজ ১০ বছর কেটে গেছে, আজ আমি চিৎকার করে বলতে পারি, ঐদিন ১১৩ মিনিটে কাতালুনিয়ার ক্লাব নীল-মেরুনের প্রতিনিধি ডন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার ম্যাজিকে সম্মোহনী মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিল সাউথ আফ্রিকা ছাপিয়ে পুরো বিশ্বে। ঐদিনের সেরা কিন্তু আমাদের জাভি হার্নান্দেজই ছিলেন।
আজ যখন পিছনে ফিরে স্পেনের বিশ্ব বিজয়ের পরের দিন অর্থাৎ ১২ জুলাইয়ের ক্লাসের সেই মূহুর্তটি দেখি , মনে প্রশ্ন জাগে,
“কেন তিনি জানতে চাইলেন না ঐ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল কে জিতেছে, কেনই বা সেরা গোলকিপারের নাম জানতে চাইলেন না, ওনার কেনই বা জানতে হবে ঐ পার্টিকুলার দিনের সেরার নাম ?”
৩.
জীবন যদি রোশনাই মৃদু আলোর কোনো চলচ্চিত্র পট হয়, তাহলে ঐ মূহুর্ত কি জীবন নামের সিনেমায় একটি ভালোবাসার সূত্রপাতের ইঙ্গিত দেয়? যে ভালোবাসাটার সূত্রপাত তারও ৪ বছর পর? জাভি ইনিয়েস্তা নিজেদের জীবনটা যে ক্লাবের প্রতি নিবেদন করে দিয়েছে, লয়ালটির অন্যরকম উদাহরণ হয়ে রয়েছে সে ক্লাবটার প্রতি যে ভালোবাসাটা মোহ নয়, এটা আত্মিক, সেই মূহুর্ত কি তারই প্রতিফলন? নাহলে, নাহলে আমার সেনানীদের সর্ব বিজয়ের পরের দিনই তখন ক্লাব ফুটবল নামের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে থাকা আমি, কেন একই সূত্রে গাঁথা পরব? কেন তাদের অর্জন গুলো অজ্ঞতা সত্ত্বেও আমার কাছে এসে ধরা দেবে? বার্সার প্রতি ভালোবাসা অর্জিত হলে এটা সম্ভব নয় এ ভালোবাসা সহজাত। জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়িদের প্রতি ভালোবাসা জন্মগত, এই সেনানীদের সমর্থন করাই আমার নিয়তি।। Hey I was born to support Barca, to Which Xavi Iniesta are loyal….
২০১০ বিশ্বকাপের পর ঘরে এক চতুর্ভুজাকৃতির যাদুর বাক্স না টেলিভিশনেই দেখতাম, যে মেসিকে প্রথম চিনেছিলাম নীল-সাদা জার্সিতে যার প্রতি আলাদা ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল সে মেসি সবুজ ঘাস রাঙাচ্ছে মেরুন-নীল জার্সিতে। এ কেমন কথা, আর্জেন্টিনা ছেড়ে ও বার্সেলোনা নামের দেশে খেলে! বড়-সড় ধাঁধায়ই পড়েছিলাম সেদিন, পরে কাঠ-খড় পুড়িয়ে জানতে পারি (অন্তর্জাল না থাকায় কাঠ-খড় পুরানোই লেগেছিল) আসলে বার্সা একটি ক্লাব, আর মেসি ক্লাব ফুটবলে বার্সার হয়ে খেলে। মেসি যে দলেই থাকুক, মেসির জন্য শুভকামনা, সাথে ঐ দলটার প্রতিও।যখন টিভিতে স্কোর দেখি বার্সা জিতেছে, অনন্য একটা উপলদ্ধি হতো। তখন থেকে একটা মোহ কাজ করা শুরু করে -এ বার্সা সর্বজয়ী, যে মোহ ভাঙবে ২০১৭ তে। ও হ্যাঁ এখানেই প্রণয়।
২০১৪ তে যখন বিশ্বকাপ আসে তখনও জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়েলকে চিনতাম না অথচ শব-ই-মেরাজের পবিত্র রাতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন নেদারল্যান্ডের মুখোমুখি হয়; বাড়ির সবাই মিলে সে খেলাটা দেখেছিলাম। সে ম্যাচে কোন এক অদ্ভুত কারনে স্পেনের জন্য গলা ফাঁটালাম। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে স্পেন ৫-০ গোলে হারে (গুগল করিনি বিশ্বাস করেন)। সে রাতে কুকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক পুয়েলের জন্য বড্ড কষ্ট হয়, সাথে ঐ টেকো মাথার ভদ্রলোকের জন্যও। বিলিভ মি, আমি তখনও জানতাম না তারা বার্সার লিজেন্ড। তখনও বুঝতে পারিনি আমি তো আর্জেন্টিনার ফ্যান তাহলে কেন এদের প্রতি আমার এত কষ্ট লাগবে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে? ঐ বিশ্বকাপে খুব স্বাভাবিক ভাবে চলে কাজিনদের ফেভারিট দল ব্রাজিল আর নেইমারকে পঁচানো।
বিশ্বকাপ চলে যায়, বিশ্বকাপে মোহ কাঁটে না। প্রথমবারের মতো দেখতে শুরু করি বার্সার ম্যাচ। এ বার্সা ক্যাম্প ন্যুর সবুজ গালিচায় আনন্দের এক পসরা সাঁজায়, তাদের দুজন শিল্পী আছে জাভি আর ইনিয়েস্তা, জাভি আবার অধিনায়ক তার মুখ দেখে ভয় হয়; সেই শিল্পীরা তাদের পদ তুলি দিয়ে ক্যাম্প ন্যুর ক্যানভাসে অতীব সুন্দর রঙের বাহার সাঁজায়। এই চিত্রপট বোধ হয় লিওনার্দো ভিঞ্চি আর পাবলো পিকাসোর চিত্রক্রমকেও হার মানাবে। ব্রাভোর কাছে যক্ষের ধণ হলো ত্রিকাঠি, এ ব্রাভো গোল হজম করে না, করলেও সমস্যা নেই! আরো তিনজন আছে যারা তা পুষিয়ে দিতে পারে আর এরা হলো বিধ্বংসী ত্রয়ী মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার; ঐযে বার্সা হারে না! সে এক ফুটবলের সৌন্দর্য, লং পাস গুলো মন ছুঁয়ে যায়, এরা বল হারায় না, এরা স্বর্গীয় সৌন্দর্যের ঝাঁপি খুলেছে, আর আমরা সেই স্বর্গে আমন্ত্রিত। এল-ক্লাসিকো আসে, টিভিতে কি যেন স্বাধীনতার কথা বলে, স্বধিকারের কথা বলে, লড়াইয়ের কথা বলে। বুঝিনা, তবে এ পাঁচবছরে ইন্টারনেট অনেক উন্নতি করেছে, কাঠ-খড় পুড়াতে হয় না এখন আর, মুঠোফোন ঘাটলেই সবকিছু বেরিয়ে আসে; সংগ্রামের ইতিহাস টাচ করে, প্রতিবাদী বার্সাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলি তখনই। সাথে ঐযে ব্রাজিলের নেইমার ছোকরাটা, ও মেসির পিছু ছাড়ে না, সুয়ারেজের সাথে ওর কি দুষ্টামি, খুব ভয় হয় ইঞ্জুরি বাঁধিয়ে ফেললে! সে ছোকরাটাকে কখন যে মন দিয়ে বসি বুঝতে পারিনি, মেসির ২ মাস ইঞ্জুরি ছিল একটা সময় এ ছেলেটা দলটাকে টেনেছে, তখন মনে হয় নেইমারের প্রতি ভালোবাসাটা গাড় হয়, ন্যাশনাল টিমের রাইভাল প্লেয়ার এ গাড় রংয়ের ভাটা আর কারো প্রতি পরবে না । আর বার্সার প্রতি সেতো ট্রেবল জয়ের পরই আমার মনে বাসা বেঁধেছে। মেসির প্রতি ভালোবাসা কখন যে বার্সার প্রতি ভালোবাসায় বদলে গেছে তার ঊত্তর আতশ কাঁচ দিয়ে খুঁজলেও মেলে না।সর্বজয়ী বার্সা পিএসজিকে ৬-১ এ হারাতে পারে, রিয়ালকে ৩-২ এ।
এরপর মোহ কাঁটার পালা। নবজাতক শিশুর বেড়ে ঊঠার পালা, সমাজের কপটতার মুখোমুখি হওয়ার পালা। এ গল্পটা হতাশার, এ গল্পটা এক রাবণের। এ গল্পটা বার্তেমেওর। এ গল্পটায় জয় আছে, তবে স্বপ্নপুরীর খুশি নেই। জাভি-ব্রাভোরা চলে যায়, নেইমার চলে যায়, সেই চিত্রকরদের জায়গায় আসে নূতন কুড়ি, তবে শিল্পীদের জায়গা অপূরণীয় রয়ে যায়, ভালভার্দে নামটার সাথে রাবণের সেই ভয়াল থাবার তুলনা করলে বড্ড ভুল হবে না, লা মাসিয়ানদের অবজ্ঞা করে এত এত টাকার প্লেয়ার কিনে ব্যর্থতার জালে পরিবিষ্ট হওয়া, এ বার্সা সর্বজয়ী নয়, এ বার্সা হারে রোমা, লিভারপুল, বায়ার্নের কাছে। রাবণ তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে ফেলেছে, আই-থ্রী ভ্যাঞ্চিওর কি লজ্জা, তবুও রাবণের রাজ্য ছাড়ার বালাই নেই। রাবণের রাজ্যে রাম আজ অসহায়, জাভি-ইনিয়েস্তাদের মতো সেও চায় এই রাক্ষসদের রাজ্য থেকে পলায়ন করে বাঁচতে,রাক্ষসদের হিংস্রতায় বার্সা বনাম মেসি হয়। তবুও এ মন আজও স্বপ্ন দেখে রাম তার সীতারূপী বার্সাকে কোন এক হনুমানের সাহায্যে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করবেই। সে হনুমান কি কোম্যান হবে? তা নাহয় সময়ের হাতেই তোলা থাক। ক্যাম্প ন্যুর সেই হারানো সুর শোনার আগ্রহ হৃদয়ের কোণে দানা বাঁধে আজও। সেই ভয়ংকর বার্সা, মেসির বার্সা, ইনিয়েস্তার বার্সা, জাভির বার্সা, সংগ্রামীদের বার্সার স্বপ্ন আজও দেখি।
এ বার্সার ১২তম সদস্যের কারনেই আর্জেন্টিনা থেকে আজ বহুদূরে আমি সত্ত্বা। সে গল্পের ঝাঁপি আরেকদিন খুলব চারটা বাজে প্রায়। আর সাথে হারানোর সুরের প্রত্যাবর্তন সেটাও সময়ের হাতেই তুলা থাকা। আজ না হয় রবী ঠাকুরের ছোট গল্পের মতোই শেষ করি—
“শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।”