ফুটবলে কিছু মানুষের সাফল্য শুধু ট্রফির নিরিখে বিচার করা যায় না। এরকমই একজন হলেন লিভারপুলের বর্তমান কোচ জার্গন ক্লপ, ২০১৮-১৯ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আগে যিনি শেষবার বড় ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন ২০১২ সালে। কিন্তু তিনি এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যার খেলায় প্রভাব তার সাফল্যের থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত। একজন খেলোয়াড় বা একটা দলের খেলায় ধাপে ধাপে উন্নতি ঘটানোর দক্ষতার জন্য গোটা বিশ্বের কাছে আজ তিনি একজন আদর্শ রোল মডেল।
২০১৫-১৬ ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি পর্বে ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে শেষ আধ ঘন্টায় তিন গোল হোক বা সাম্প্রতিককালে বার্সেলোনার কাছে তিন গোলে হেরে আসার পর নাটকীয় পটপরিবর্তনের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ছাড়পত্র জোগাড় করা — অ্যানফিল্ডে তার পদার্পণের পর থেকে লিভারপুলের বেশ কিছু স্মরণীয় কামব্যাকের কাহিনীর নেপথ্যেই থেকেছেন “দ্য নর্মাল ওয়ান।” আর সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ তিনি শুধু নিজের ট্যাক্টিক্স তৈরি করতে যদি ৩০% সময় নিয়োজিত করে থাকেন তাহলে বাকি ৭০% সময় ব্যয় করেছেন দলকে এক সুতোয় বাঁধতে আর সেই দলের টিমস্পিরিটকে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে যেতে। ড্রেসিংরুমের আবহ তিনি একা তৈরি করেননি, বরং সেটা তৈরির ক্ষেত্রে ড্রেসিংরুম শেয়ার করা প্রত্যেকটি সদস্যকে করে তুলেছেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সমান সচেতন।
আজকের খেলা কখন, কোন চ্যানেল দেখতে ক্লিক
ডর্টমুন্ড থেকে লিভারপুল অবধি অসংখ্য খেলোয়াড়কে ক্লপ করে তুলেছেন “পোটেনশিয়াল স্টার” থেকে “ওয়ার্ল্ড বিটার।” হয়তো সেই স্তরের খেলোয়াড়রা ফুটবলটা ৮০% জানতেন এ জন্যই সেই স্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন, কিন্তু বাকি ২০% যে বিশ্বমানের খেলোয়াড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কতটা নির্ণায়ক সেটা এই জার্মান কোচ খুব ভালো করেই জানতেন। আর তাদের উত্তরণের পথে শেষ ধাপটা যাতে সঠিক হয় ঠিক সেটাই একের পর এক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
যেসব নতুন খেলোয়াড়দের তিনি সই করিয়েছেন, বিশেষ করে লিভারপুলের জন্য, সেগুলোর মধ্যে কোনো একটাও খারাপ সাইনিং হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। ক্লপ ভালো করেই জানেন যে একজন খেলোয়াড়কে সই করালে সেটা তার দলের পক্ষে ভালো “হতে পারে” এটা ভেবে কখনো মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করা সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রত্যেকটা নতুন সাইনিংয়ের আগে তার টার্গেট প্লেয়ারকে জানার চেষ্টা করেন, শুধু বাইরে থেকে তার ফুটবল স্কিল সম্পর্কে নয়, তার সাথে তার মানসিক গঠন ও চিন্তাধারা সম্পর্কেও। সেই খেলোয়াড়রা যখন প্রথম তাদের নতুন কোচের সাথে সংস্পর্শে এসেছেন, অনেকেই অবাক হয়ে গেছেন এটা ভেবে যে মানুষটা তাদের সঙ্গে ফুটবল ছাড়া বাকি সবকিছু নিয়েই কথা বলছেন। খেলার বিষয়ে প্রচুর তথ্য বা ইনসাইটস ক্লপের কাছে থাকলেও তিনি প্রথমেই তার নতুন খেলোয়াড়দের সেগুলো দেন না, কারণ তিনি জানেন যে এই ইনফরমেশনের বস্তা তাদের ওপর ওভারলোড হয়ে উঠতে পারে, থাবা বসাতে পারে তাদের স্বাভাবিক খেলায়। তিনি তাই প্রথমে স্বাধীনভাবেই খেলতে দেন তাদের; দেখে নেন যে তারা কিভাবে খেলছে, তাদের নতুন কি করতে বলতে হবে আর ঠিক কি কি করা থেকে তাদের বিরত রাখতে হবে।
আসলে জার্গেন ক্লপের কোচিং বোধ যতটা তুখোড় ঠিক ততটাই পরিপক্ক তার ম্যানেজমেন্ট স্কিল। বড় ক্লাবে কোচিং করানোর আগে বুন্দেসলিগা দ্বিতীয় ডিভিশনে কোচিং করানোর সময় তিনিই ছিলেন মেইনজ ক্লাবের সর্বেসর্বা, যেখানে ফুটবল টিম সম্পর্কিত সবকিছুর দেখাশোনা তাকে একা হাতেই করতে হতো। আজ তার কাছে হয়তো ১৯-২০ জন সহকারী কোচ রয়েছেন, আর তারা কি করছেন, কতটা দক্ষতার সাথে করছেন সেটার তদারকিও তিনি করতে পারেন, কারণ একটা সময় তিনি নিজে সেই সব কাজই করে আসার দৌলতে বিষয়গুলো অনেকের থেকেই অনেক ভালো বোঝেন।
আজকের এই ক্লপ কে দেখে বারবার 2012-2013 সালের কথা মনে পড়ে যায়। ডর্টমুন্ড এর সময়কাল। সেদিন তার আশা পূরণ হয়নি ; তাই বলে তিনি একগাদা স্বপ্ন বিলিয়ে দেননি । প্রত্যেকবার খালি হাতে ফিরতে ওনাকে হয়নি। সেসব দিনে ওনার লিগ জয় একটা বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। তবু সেই পাওয়ার পরিমাণ খুবই সামান্য, খুবই অনায্য। কোনও অভিযোগ নেই। বেখেয়ালি মন্তব্য নেই। দিনের পর দিন সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও উনি স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারেন, ডর্টমুন্ড এর লাখো লাখো রক্ত মাংসের, দোষ গুণে ভরা মানুষের মনেও অনেক আশার বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই লোক টি।