ধরে নাও ফুটবল খেলাটিকে একটি মহাবিশ্ব, আর এই মহাবিশ্বে রয়েছে অগণিত নক্ষত্র । যেমন পেলে, ম্যারাডোনা, ক্রুইফ, স্টেফানে, মুলার, জিদান সহ আরও অনেকে। আর এই নক্ষত্রদের মাঝে এ যুগের একজনকে বের করতে দিলে তুমি খুব বেশ মুশকিলে পড়ে যাবে। ধরো তোমাকে যদি বেছে নিতে দেওয়া হয় দুজনকে তবে সেই দুইজনের একজন হবে অবশ্যই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
জুভেন্টাসের এই পূর্তগীজ রাজপুত্র ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ক্রিস্টিয়ানোকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়তে হচ্ছে, তাকে নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে যে, তার বিষয়ে কোন কিছু বলাই পুরনো কাসন্দি ঘাটার ব্যাপার। সেজন্যই তার ক্যারিয়ারে আর যাচ্ছি না। রোনালদোর স্পোর্টিং লিসবনে বেড়ে উঠা দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ঘুরে রিয়াল মাদ্রিদে এসে ইতিহাস সৃষ্টি এবং সবশেষে জুভেন্টাসে কিংবা পূর্তগাল নিয়ে তার রচিত রুপকথা সকলেই জেনে গেছেন। তাই আজ নাহয় আমি একটু ভিন্ন কিছু বলি!
জানেন কি?তখনকার বার্সা প্রেসিডেন্ট লাপার্তো একটু চেষ্টা করলেই রোনালদোকে বার্সেলোনায় নিয়ে আসতে পারতেন! ২০০৩ সালে রোনালদিনহো যখন বার্সেলোনায় যোগ দেয় তার সাথে সেই ট্রান্সফারেই আসে রাফায়েল মার্কুয়েজ ও রিকার্দো কুয়ারেজমা। মার্কুয়েজ আর কুয়ারেজমার চুক্তির ব্যাপারটি দেখছিলেন জর্জ মেন্ডিস যিনি তৎকালীন বার্সা প্রেসিডেন্ট লাপর্তোকে রোনালদোর ব্যাপারে জানান। মেন্ডেজ ১৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রোনালদোকে বার্সার কাছে বিক্রি করতে রাজি হয়,কিন্তু রাজি হন নি লাপার্তো। সেই ট্রান্সফারেই ১৯ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যোগ দেয় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এরপর যা ঘটে সেটা তো ইতিহাস!
সেদিন লাপার্তো রাজি হলেই ইতিহাস হয়তো পাল্টে যেতো, হয়তো আমরা আজ লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এক দলেই খেলতে দেখতাম। সে যাই হোক ক্রিস্টিয়ানো কখনো বার্সেলোনায় খেলতে আসে নি, কিন্তু বার্সার লিওনেল মেসির সাথে প্রায় গলায় গলায় টক্কর দিয়ে এসেছে গত এক যুগ ধরে। আর ঠিক সেই জায়গায়ই ভুক্তভোগী এই সময়ের সব দুর্দান্ত ফুটবলাররা। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, রাজা- রাজায় যুদ্ধ উলুখাগড়ার প্রানান্ত। ঠিক সেরকমই এই দুইজনেরই লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত ছিল অন্য ফুটবলাররা।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করা যাক, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কি লিওনেল মেসির সমান গড গিফটেড? উত্তরটার হবে অবশ্যই “না”। মেসির যে প্রাকৃতিক ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা আছে সেটা রোনালদোর তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। খেয়াল রাখবেন আমি কিন্তু এখানে মেধার কথা বলছি না! বলছি ঈশ্বর প্রদত্ত প্রাকৃতিক প্রতিভার কথা। দুজনেই মেধাবী নয়তো কেউই এতদূর পর্যন্ত আসতো না! কিন্তু মেসির যে ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা বেশি সেটা তুমি যত বড়ই কট্টর পন্থী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ভক্ত হও না কেনো তোমাকে তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু এরপরও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো লড়ে যাচ্ছে তাও যতটা সম্ভব সমান তালে! কি করে? জেদ আর জয়ের ক্ষুধার জন্য।
পেশাদার ফুটবলে প্রায় দেড় দশক কাটানোর পরও এগুলো তার একফোঁটা ও কমেনি বরং সময়ের সাথে সাথে আরও বেড়েছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটা প্রচন্ড বলেই নিজেকে গত ২০ বছরের সেরা খেলোয়াড় দাবি করেছিলেন। জেদটা অদম্য বলেই “ব্যালন ডি অর” এর রেসে ৪-১ ব্যাবধানে পিছিয়ে পরেও ফিরে আসে,ব্যাবধান সমান করে ৫-৫ এ। নিজের সীমাবদ্ধতা ক্রিস্টিয়ানো জানে কিন্তু সেটাতে আটকে পরে পিছিয়ে পড়তে সে নারাজ। ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম করে, আগের দিন প্রাকটদনিজেরিসে বাইসাইকেল কিকটা ঝালিয়ে নিয়ে পরের দিন প্রতিপক্ষের মাঠেই বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলকিপারকে পরাস্ত করে সেই বাইসাইকেল কিকেই! শরীরে কখনো মেদ জমতে দেয় না! শরীর যেন বয়সের বাড়ে ভারাক্রান্ত না হয়ে পরে সেদিকে তীব্র মনোযোগ তার। এসব মিলিয়েই রোনালদো হয়ে উঠে অনন্য।
আরেকটি ব্যাপার রোনালদোকে অসাধারণ করে তুলেছে সেটি হলো তার অভিযোজন ক্ষমতা। ক্যারিয়ারের শুরুতে রোনালদো ছিল ক্লাসিকাল উইঙ্গার কিংবা উয়াইড উইঙ্গার। উইং ধরে দৌড় শুরু করলে তাকে ঠেকানোর সাধ্য ছিল কার? দুর্দান্ত ড্রিবলিং সাথে ছিল দু পায় সমান ভাবে ব্যাবহার করার ক্ষমতা, কাউন্টার এটাকেট জন্য রোনালদো ছিল তখন যেকোনো কোচের জন্য আদর্শ প্যাকেজ। সেই ক্ষমতা নিয়েই সে এসেছিল স্যার এলেক্স ফারগুসনের ইউনাইটেডে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এসেই বেকহাম,বেসদের রেখে যাওয়া ৭ নাম্বার জার্সি গায়ে জড়িয়ে উইং ধরে ডিফেন্ডারদের তুর্কিনাচন নাচাচ্ছিলো সে।
তবে ২০০৮ সালে স্যার এলেক্স ফারগুসন নতুন কৌশল ট্যাকটিস অবলম্বন করেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তখন শুরু করে কোন নাম্বার নাইন বিহীন ৪-৩-৩ ফর্মশনে। ৪-৩-৩ এ আক্রমণ ত্রয়ী ছিল রোনালদো, রুনি, তেভেজ যারা কিনা কেউই নাম্বার নাইন ছিল না। তাছাড়া স্যার এলেক্স ফারগুসন ও কাউকে নির্দিষ্ট কোন পজিশন ও দিয়েছিলেন না, নিজেদের মধ্যে তারা বারবার জায়গা পরিবর্তন করে একেকজন একেক সময় একেক পজিশনে খেলতো। এই সময়ে ততদিনে রোনালদো শারীরিক গঠনে ও মনোযোগ দিয়েছিল সাথে সুঠাম দেহ গড়ে ফেলেছিল। এতে নাম্বার নাইন পজিশনে খেলতে ও তার কোন সমস্যা ছিল না। অবশ্য সে এতদিনে উইং ধরে ত্রাস ছড়ানো রোনালদো নয়, বরং উইং থেকে বের হয়ে এসে প্রতিপক্ষকে ঝামেলায় ফেলে নাকানিচুবানি খাওয়াতে সে সিদ্ধহস্ত।
২০০৯ সালে যখন রিয়াল মাদ্রিদে যোন দেন ক্রিস্টিয়ানো রোনলাদো তখন তার বেশ ঝামেলায় পড়ার কথা ছিল, কারন ইংল্যান্ডের আর স্পেনের লিগ অত্যন্ত ভিন্ন ধরনের দুটি লিগ। একটিতে যেখানে ফিজিক্যালি মূল হাতিয়ার আরেকটিতে টেকনিক। কিন্তু রোনালদো তার অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতার জোরে সেখানে মানিয়ে নিলো,,কিন্তু সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়। একে তো পেপ গার্দিওয়ালার বার্সেলোনার জন্য কিছুই জিততে ছিলো না রিয়াল মাদ্রিদ, সঙ্গে ছিল অপ্রতিরোধ্য ফর্মে থাকা লিওনেল মেসি তাকে সুযোগই দিচ্ছিলো না কিছু জেতার। তবে ২০১২ তে বার্সাকে টপকে লিগ জিতলো রিয়াল মাদ্রিদ, কিন্তু সে বছরই আবার লিওনেল মেসি একাই করে ফেললো এক দলের সমান গোল অর্থাৎ ফুটবলের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ ৯১ গোল। সেই বছর ব্যালন ডি অর ও যে আর কেউ পাবে সে সম্ভাবনাকে ও ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল লিও মেসি।
আজকের খেলা কখন, কোন চ্যানেলে দেখতে ক্লিক করুন
ক্রিস্টিয়ানো তখন টের পেলো তার গতি কমে গেছে, ড্রিবলিং বা ক্রসিং কোনটিই আর আগের মতো নেই, উইঙ্গার হিসেবে খেলে মেসিকে ধরতে পারবে না কখনোই সে। তাই সে আবারও তার খেলার ধরন বদলালো সে, ইনভার্টেড উইঙ্গার পজিশন ছেড়ে হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর সেন্টার ফরোয়ার্ড। তখন সে নামেই শুধু উইঙ্গার ছিল, খেলার শুরুতে ফর্মেশনে বাম প্রান্ত থেকে শুরু করলেও রেফারির বাজি বাজার সাথে সাথেই সে হয়ে যায় পুরোদস্তুর ফক্স ইন বক্স। উইঙ্গার হিসেবে খেলার এডভান্টেজ এর সাথে তার যোগ হলো লাফ দেওয়া এবং বাতাসের সাথে নিজেকে ঝুলানোর ক্ষমতা, আর এতেই ২০১৩ সালের পর থেকে ক্রিস্টিয়ানো হয়ে উঠে একজন অপ্রতিরোধ্য সেন্টার ফরোয়ার্ড। এভাবে পজিশন বদল করেই খেলেই সে মেসির সাথে ব্যালন ডি অর ব্যাবধান শূন্যে নামিয়ে নিয়ে আসে সাথে রিয়ালের ৫ বছরের মধ্যে ৪ টা চ্যাম্পিয়নস লিগের পথিকৃৎ সে।
এখন হয়তো বয়সের ভারে আর আগের মতো দম নেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। গত ৫ ই ফেব্রুয়ারি এই পূর্তগীজ রাজপুত্রের ৩৫ তম জন্মদিন ছিল। বয়স ফুরিয়ে আসছে, বুটজোড়া হয়তো তুলে রাখবে বছর কয়েক পরেই। ততদিন হয়তো ফুটবলকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করবে ক্রিস্টিয়ানো, ভাসিয়ে দিবে আনন্দ বন্যায়। নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় সেই বন্যায় ডুবতে অধিকাংশ ফুটবল প্রেমীদের আপত্তি নেই।