২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকে অনেকটা সময়ই শেন ওয়াটসনকে কাটাতে হয়েছে নিজের চোটপ্রবণ কেরিয়ারের রোলারকোস্টারে চেপে। বাইরে থেকে ফটোশ্যুটের জন্য আদর্শ অ্যাথলেটিক ফিগার মনে হওয়া শরীরটা যে ভেতর থেকে খুব একটা শক্তপোক্ত ছিল না তার প্রমাণ পিঠের ব্যথা বার বার ফিরে আসা, হ্যামস্ট্রিংয়ের সমস্যা, কাফ মাসেলে টান, হিপ-জয়েন্ট ইনজুরি বা ডিস্লোকেটেড শোল্ডারের মতো একের পর এক ঘটনা। মানুষটি এমন একটা যুগের ব্যাগি গ্রিন টিমের সদস্য ছিলেন, যে টিম মাঠে নামার আগেই অর্ধেক ম্যাচ জিতে যেত। যদিও তখন তিনি সবে সবে ক্রিকেটকে ভালোবেসে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করছেন, তাও তাঁর মধ্যে ব্যাগি গ্রিনের চেনা ঔদ্ধত্য সমালোচক তথা আপামর ক্রিকেট দর্শকদের সহজেই চোখে পড়েছিল।
ক্রিকেট প্রেমিক রা জেনে থাকবেন সেই সময় বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করা ঐ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল বিরাট কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু এই ভদ্রলোক সে বছর গ্রীষ্মে খোদ স্টিভ ওয়ার বদলেই দলে জায়গা পান কিন্তু খুব একটা আহামরি কিছু করতে পারলেন না, অগত্যা দল থেকে বাদ। ব্যাগি গ্রীন বড়োই নিষ্ঠুর, একটা সামান্য ভুলের মাশুল অবধি তারা আদায় না করে থাকেনা।
কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। তিনি তার ট্রেনিংয়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন, অ্যালকোহল ছেড়েছেন আর করেছেন আগের থেকে অনেক সংযত জীবনযাপন। নিজের মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে হতাশার অন্ধকারকে জয় করে হয়ে উঠেছেন নিজের সময়ের বিশ্বসেরা লিমিটেড ওভার অলরাউন্ডার।
আজকের খেলা কখন, কোন চ্যানেলে দেখতে ক্লিক
ওয়ান ডে অভিষেকের তিন বছর পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়াটসনের মাথায় ওঠে বহুকাঙ্খিত অস্ট্রেলিয়ান ব্যাগি গ্রিন টুপি। প্রায় চার বছর টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং অর্ডারে ওঠানামা করার পর অবশেষে ২০০৯ সালে ওপেনার হিসাবে সুযোগ পান তিনি, আর প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের প্রথম টেস্ট শতরানসহ টানা আটটি ইনিংসে করেন ৫০ বা তার বেশি স্কোর। এছাড়াও ২০১০ এ মোহালির ভাঙা পিচে ধৈর্য্যশীল সেই সেঞ্চুরি,
২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যেন তাঁর নামেই লেখা ছিল। নিজের দুরন্ত অল রাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে বলা চলে প্রায় একা হাতে তিনি বিশ্বকাপ জেতার কাছাকাছি চলে গেছিলেন। এখানে তিনি একটি রেকর্ড করেন পরপর ৪ টি ম্যাচে “ম্যান অফ দ্য ম্যাচ” হয়ে।
আর হ্যাঁ তিনি ই একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি ক্যাপ্টেন হিসাবে টি টোয়েন্টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন এবং উইকেট নিয়েছেন। এছাড়াও তিনি রেকর্ড ১২০ সপ্তাহ আইসিসি র্যাঙ্কিং এ একটানা বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন।
মূলত বোলিং অলরাউন্ডার হয়ে আসা এই ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে তিন ফরম্যাটেই অধিনায়কত্ব করেছেন। তবে সে রেকর্ড খুব একটা ঈর্ষণীয় নয়। ২০১৩ সালে ইন্ডিয়ার সাথে সিরিজ চলাকালীন কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই তৃতীয় টেস্টে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়, যা নিয়ে ক্যাপ্টেন ও কোচকে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই সিরিজের শেষ টেস্টে তিনি তাঁর জীবনের একমাত্র টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছিলেন।
২০১৩ তে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওভালে নৈস্বর্গিক ১৭৬ আর তার কয়েক মাসের মধ্যেই আবারও একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পার্থের গতিময় উইকেটে হান্ড্রেড তার টেস্ট জীবনের অন্যতম হাইলাইটস। ওপেনিংয়ে নেমে ১৫টা ওভার বাউন্ডারি আর সমসংখ্যক বাউন্ডারির বিস্ফোরণে বাংলাদেশকে তছনছ করে ৯৬ বলে অপরাজিত ১৮৫ হোক বা মিডল অর্ডারে ব্যাট করে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়াহাব রিয়াজের ভয়ংকরতম স্পেলকে সামাল দিয়ে ঘরের মাঠে দেশের মুখরক্ষা করা হোক; দলের প্রয়োজনে সব পজিশনেই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছেন এই “ওয়াট্টো।”
রঙিন পোশাকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তো বটেই, একাধিক দেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগেও বিভিন্ন সময়ে তার অসংখ্য স্মরণীয় পারফরম্যান্সের সাক্ষী থেকেছে ক্রিকেটমহল।
আইপিএলের উদ্বোধনী মওসুমে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হওয়া থেকে শুরু করে শেষবার রক্তাক্ত হাঁটু নিয়েও চেন্নাই সুপার কিংসকে শেষ মুহূর্ত অবধি লড়াইয়ে টিকিয়ে রাখা। এর মাঝে কোনো বছর হয়তো তিনি চোটের কারণে বোলিং বেশি করতে না পারলেও ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন, কখনো হয়তো ব্যাটিংয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেননি, কিন্তু উইকেট নিয়ে সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন আবার কখনো বা মওসুমের সেরা পারফরম্যান্সটা তুলে রেখেছেন ফাইনালের জন্য — অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে প্রায় প্রত্যেকটা বছরেই তার প্রদর্শন থেকেছে ঈর্ষণীয়।
দুবার অ্যালান বর্ডার মেডেল বিজয়ী এবং আই সি সি টি টোয়েন্টি অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান রেকর্ড ১২০ সপ্তাহ টানা ধরে রাখা সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন-আজ (১৭.০৬.২০) ৩৯ বছর পূর্ণ করলেন।
শুভ জন্মদিন শেন ওয়াটসন